ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনায় আইসিটি মামলায় গ্রেফতার ওসি মোয়াজ্জেমকে রাজধানীর শাহবাগ থানায় বিলাসী আপ্যায়ন করা হয়েছে। খাবার থেকে শুরু করে সকল বিষয় সম্পন্ন হয়েছে সংশ্লিষ্ট থানার পরিদর্শকের কক্ষে। তাকে থানার হাজত কাস্টডিতে রাখা হয়নি। ওসি মোয়াজ্জেম পুরো রাত কাটিয়েছে পরিদর্শক অপারেশনের কক্ষে।
থানার একাধিক গাড়ি চালক না প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাজধানীর হাইকোর্ট সংলগ্ন কদমফোয়ারার পাশ থেকে ধরা পড়ার পর রাতে শাহবাগ থানায় রাখা হয় মোয়াজ্জেমকে। তাকে গোপনে পুলিশ অফিসারের কক্ষে রাখা হয়েছিল। সাধারণত আসামিকে হাজতে রাখা হলেও তাকে সেখানে নেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, গ্রেপ্তারের পর রাতে ওসি মোয়াজ্জেম শাহবাগ থানায় অফিসারদের কক্ষেই ঘুমিয়েছেন। সকালে প্রিজন ভ্যানে তোলার আগে পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মাহবুবুর রহমানের কক্ষে সকালের নাস্তাও সেরেছেন তিনি।
অপরদিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোয়াজ্জেমকে কারাগারে পাঠনোর নির্দেশের পরই তাকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গেটে তার বন্দি রেজিস্ট্রেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ প্রক্রিয়া সম্পন্নের পরই তাকে বিশেষ সেলে ( সেমি ভিআইপি) নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সেলে তার আপ্যায়ন ও ফুটফরমায়েস করার জন্য ২ জন শিক্ষিত বন্দিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি খাবারের বিষয়ে তার পিসিতে মোটা অংকের টাকাও জমা দেয়া হয়েছে। একাধিক কারারক্ষী তার সেলের সামনে পাহারা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে পিসির টাকা দিয়ে কারা ক্যান্টিনের খাবারের পাশাপাশি বাইরে থেকেও খাবার নেয়া হচ্ছে কারারক্ষীদের দিয়ে। তবে গতকাল রাতে কারা কর্তৃপক্ষের দেয়া কোনও খাবারই খাননি সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম।
মোটামুটি ভাবে কারাগারে সবকিছুই পাচ্ছেন তিনি। গতকাল দুপুরে কোর্টহাজতে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন ছেলে ও গাড়িচালকসহ স্বজনরা। এসময় তারা ওসি মোয়াজ্জেমের জন্য কাপড়-চোপড়, টুথপেস্ট ব্রাশ, টুপি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, ধর্মীয় বই, সেন্ডেলসহ অন্যান্য ব্যবহারিক সামগ্রী দেয়া হয়।
আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাতের কথা রয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, গতকাল বিকেলেই পরিবারের পক্ষ থেকে কারাগারে মোয়াজ্জেমের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আবেদন করেছেন স্বজনরা।
পুলিশের বিশেষ শাখাসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার যাচাই বাছাই শেষে প্রয়োজন মনে করলে বা গ্রিন সিগন্যাল পেলে কারা কর্তৃপক্ষ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতের সুযোগ দিবেন।
এ বিষয়ে কারা অধিদফতর ডিআইজি ( ঢাকা বিভাগ ) টিপু সুলতান বলেন, শুধু ওসি মোয়াজ্জেম নয়, যে কোনও বন্দি জেলকোড অনুযায়ী তাদের খাবার থেকে শুরু করে সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। জেল কোডের বাইরে কোন বন্দিও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ প্রতিদিনই আসামি ধরে আদালতে নেয়, কিন্তু এই ধরনের দৃশ্য দেখা যায় না। নানা সময় ছোটখাটো অভিযোগ নিয়ে আদালতে তোলা আসামিদের হাতকড়া পরিয়ে বা কোমরে রশি বেঁধে নেয়া হয়েছে আদালতে। কিন্তু ওসি মোয়াজ্জেমের হাতও ধরেনি কেউ। তাকে কেবল ঘিরে রাখা হয়। সাংবাদিকরা যেন তার ছবি তুলতে না পারে, আপ্রাণ চেষ্টাও পুলিশ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ তার নিজের বাহিনীর এই কর্মকর্তার বিষয়ে নমনীয় কেন।
শুধু তাই নয়, গতকাল সোমবার ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে হাজির করার সময় ওসি মোয়াজ্জেমের বেশভুষা ছিল পরিপাটি। ইস্ত্রি করা গেঞ্জি পরে ছিলেন। চোখে ছিল কালো একটি সানগ্লাস। বেশ কয়েকদিনের কাটা দাড়িগুলো মোটেও এলোমেলো ছিল না। মনে হচ্ছিল বেশ যত্নে বড় হয়েছে সেগুলো। চেহারাতেও কোনো উদ্বেগ ছিল না।
এদিকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পালিয়ে যাওয়া সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে হাতকড়া না পরানোয় আদালতে ক্ষোভ জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তার বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে মামলার বাদী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন এই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, অন্য আসামিদের প্রতি পুলিশ এ রকম সদয় থাকবে কি না। সাংবাদিকদের সুমন বলেন, ওসি মোয়াজ্জেমকে হাতে হাতকড়া দিয়ে আনা হয়নি। সে বিষয়ে পুলিশ ভালো জানেন কেন আনেননি। তবে পুলিশ ভাইদের কাছে অনুরোধ করে বলেন, অন্য আসামিদের বেলায়ও যেন একই ট্রিটমেন্ট করা হয়।
ওসি মোয়াজ্জেমের প্রতি পুলিশের এই আচরণ পক্ষপাত কি না- জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা অঞ্চলের উপ কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, এ বিষয়টা ওসিকে জিজ্ঞাসা করেন। আমি কি থানায় বসে এসব দেখব? এ ব্যাপারে শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, প্রিজন ভ্যানে কোন আসামিকে হাতকড়া পড়ানো হয় না। আপনি আগে ভালো করে জানেন।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান বলেন, কোনো ব্যক্তিকে হাতকড়া পরাতে হবে কি না তার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে আমাদের দেশে সাধারণত পুলিশ অপরাধীদের হাতকড়া পরিয়ে থাকে। তাহলে মোয়াজ্জেম হোসেনকে কেন পরানো হলো না এটা একটি প্রশ্ন। এক্ষেত্রে পুলিশের একটি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ দেখা যায়। সকল ব্যক্তিকে হাত কড়া পরানো হলেও মোয়াজ্জেমকে কেন নয়? পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের ভেতরেও মোয়াজ্জেমকে ঘিরে ছিল পুলিশ সদস্যরা। এ সময় তাকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায়।
আদালত চত্বরে মোয়াজ্জেমের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে ফটোসাংবাদিকদের। অভিযোগ করা হয়েছে, নিরাপত্তার কথা বলে প্রিজনভ্যান থেকে নামানোর পর সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ গণমাধ্যমকর্মীদের তার ছবি তুলতে বাধা দেয়। দৈনিক জাগরণ